রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৯:১৭ পূর্বাহ্ন

ধোঁকা দিচ্ছে মিয়ানমার

স্বদেশ ডেস্ক:

বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন কার্যকরে দেশটি মোটেও আন্তরিক নয়, তাদের আচরণ ¯্র্েরফ ‘লোকদেখানো’ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নেওয়ার জন্য নয়, এ ইস্যুতে নেপিডোর সব কর্মকা- কার্যত বিশ্ব সম্প্রদায়ের চোখে ধুলো দেওয়ার পাঁয়তারা। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হলেও তা কার্যকরে দেশটির অনীহার কারণেই দুই দফায় ভেস্তে গেছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব কূটনীতিতে আরও কৌশলী হতে হবে বাংলাদেশকে। এদিকে রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানে প্রয়োজনীয় দায়বদ্ধতা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে পুরোপুরি

মনোনিবেশ করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়ন চলতে থাকায় প্রাণ বাঁচাতে সে দেশের সংখ্যালঘু এ জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশমুখী ঢল নামে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে। সেই ঘটনা শুরুর দুই বছর ছিল গতকাল। এদিন এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নেপিডোকে দায়বদ্ধতা ও প্রতিশ্রুতির প্রতি মনোনিবেশ করার আহ্বান জানায় ঢাকা। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, দীর্ঘস্থায়ী সংকটের জন্য পুরোপুরি দায়বদ্ধ এমন একটি দল কর্তৃক প্রত্যাবাসন প্রয়াসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ করা ভিত্তিহীন, অশুভ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। যারা যে কোনো সময় মিয়ানমারে ফেরত যেতে চান, তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে ‘কাউকে বাধা না দেওয়ার’ নীতিগত অবস্থান বজায় রেখেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী মাসে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনে বিশ্বনেতারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে চাপ সৃষ্টি করবেন মিয়ানমারের ওপর। এ চাপ এড়ানোর আগাম কৌশল হিসেবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে লোকদেখানো তৎপরতা চালাচ্ছে নেপিডো। মিয়ানমারের এ কৌশল মোকাবিলায় বাংলাদেশকেও হতে হবে আরও কৌশলী। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে স্পষ্ট করতে হবে প্রতিবেশী দেশটি যে ধুলোবাজ; একের পর এক ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ আরও জোরালো করতে অধিকতর তৎপর হতে হবে দুই বছর ধরে দেশটির ১২ লাখ নাগরিকের বোঝা টেনে চলা বাংলাদেশকে।
আশ্রিত ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৩ হাজার ৪৫০ জনকে প্রত্যাবাসনে সম্মত হলেও পরপর দুবার আন্তর্জাতিক মহলকে বোকা বানিয়েছে মিয়ানমার। শিগগির যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কার্যকর হবে, তেমন আশাও দেখছেন না বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, আগামী সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের চাপ এড়ানোর কৌশল হিসেবে মিয়ানমার দ্বিতীয়বারের মতো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চালবাজি খেলছে। মিয়ানমারের এই ধোঁকাবাজির কৌশলকে ব্যর্থ করতে হবে বাংলাদেশকেই। এ জন্য সবার আগে ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী, সেটি প্রমাণের পাশাপাশি তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, কবে নাগাদ বসতভিটা বুঝিয়ে দেওয়া হবেÑ সেসব বিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে আশ্রয়ের বোঝা টানা বাংলাদেশকে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর মনে করেন, প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের আনুষ্ঠানিকতা ¯্রফে প্রতীকী। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা নিজেদের আরাকানের স্থানীয় আদিবাসী দাবি করে তাদের নিরাপত্তা প্রদান, জমিজমা ফেরত ও গণহত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনে বিচার চেয়েছে। এসব দাবি বা শর্তের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার এসব দাবি পূরণে সচেষ্ট নয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এসব স্বীকৃতি আদায়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। আদিবাসী বা নাগরিকত্ব প্রশ্নে মিয়ানমার অনড় থাকলে রোহিঙ্গারা কোন ভরসায় সেখানে ফিরে যাবে? বাংলাদেশ সরকারের এ বিষয়টি সহজভাবে নিলে চলবে না।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাবেক বাংলাদেশ প্রধান আসিফ মুনীর আরও বলেন, রোহিঙ্গারা ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী। হয়তো শত বছরের জন্য এ দেশে আসা-যাওয়া করেছে। কিন্তু তাদের শিকড় যে মিয়ানমারে, এটা বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করা জরুরি। এ ছাড়া চীন, ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি আদায় করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় নীলনকশায় গণহত্যা, পঙ্গুত্ব, ধর্ষণ, নির্যাতনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করতে চায় দেশটির সরকার। এটি খুবই স্পষ্টÑ এমনটিই মনে করেন বিশ্লেষকরা। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে আনান কমিশনের প্রতিবেদন, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা শুরুর আগে মিয়ানমারের সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্য-উগ্র বক্তব্য, পুলিশ স্টেশনে নাটকীয় অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশে অবস্থান করা পুরনো রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের বদলে নতুন করে আরও সাত লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়ন করা হয়েছে।
এর পর আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে মিয়ানমার ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনে তাঁবু গড়ে তুললেও সেখানে অদ্যাবধি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি যে, রোহিঙ্গারা সেটি নিরাপদ মনে করবে, সেখানে ফিরে যেতে রাজি হবে। এখন তাদের ফিরে যাওয়া নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক মহলের ওপর। বিশ্বনেতারা চাইলে নানা ধরনের অবরোধের মুখে পড়ে মিয়ানমার শেষ পর্যন্ত নিজ জনগোষ্ঠীকে প্রত্যাবাসনে বাধ্য হতে পারে। আর জাতিসংঘের আসন্ন সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের চোখে ধোঁয়া দিতেই তড়িঘড়ি করে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের নাটক তৈরি করে। ২০১৮ সালের নভেম্বরেও এভাবে আরেকবার ধোঁকা দিয়েছিল দেশটি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাহাব এনাম খান বলেন, আগামী মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনের পাশাপাশি সেখানে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সভাও অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা নিধন ও বিতাড়নের বিষয়ে জবাবদিহিতা করতে হবে। তারাও সেখানে নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে যে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তাদের সদিচ্ছা ছিল। কিন্তু কিছু কিছু কারণে তা সফল হয়নি। এটি তাদের হঠকারী কৌশল।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের শর্তগুলো অনুধাবন করার প্রয়োজন আছে। তারা বলেছে, নাগরিকত্ব দিলেই ফিরে যাবে। এটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মিয়ানমার, জাতিসংঘসহ চতুর্পক্ষ নিয়ে একটি কমিশন গঠন করার বিষয়ে বাংলাদেশকে উদ্যোগী হতে হবে। যদিও মিয়ানমার এতে রাজি হবে না। তবে বাংলাদেশকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ নিয়ে কোনো ধরনের ডিপ্লমেটিক ব্লেম গেম না করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে চাপ সৃষ্টি ও অব্যাহত আলোচনা করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করা চীন, জাপানের মধ্যস্থতা গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করছেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী হলেও তারা মানবিকতার ওপর ভর করে বাংলাদেশে চেপে বসেছে। তাদের মধ্যে কতিপয় সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর উদ্ভবসহ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং স্থানীয়দের সঙ্গে বৈরী আচরণসহ নানা কারণে বাংলাদেশের নিরাপত্তা-পরিবেশ-সামাজিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের চেয়ে বাংলাদেশকেই সতর্কতার সঙ্গে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন বলেন, মিয়ানমার চাইছে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশেই থাকুক। তারা আন্তর্জাতিক মহলকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য কিছু রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার কথা বলছে। মিয়ানমার সবাইকে বোঝাতে চাইছে যে, তারাও এ বিষয়ে আগ্রহী কিন্তু বাংলাদেশই বরং প্রস্তুত নয়। মিয়ানমারের আন্তরিকতা পরিষ্কার হতো যদি দেখতাম রোহিঙ্গাবিষয়ক আইনে তারা কোনো পরিবর্তন এনেছে। যতক্ষণ না মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ আরও দৃঢ় না হবে, ততক্ষণ তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে বলে মনে হয় না।
কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন চায় যুক্তরাষ্ট্র
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। এ সংকটের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল যুক্তরাষ্ট্র এ আহ্বান জানায়। বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মর্গান ওরতেগাস বলেন, এ আগস্টে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনেরও দুই বছর পূর্ণ হলো। ওই প্রতিবেদনে কমিশন রাখাইনে ‘প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য’ দেখতে পাওয়ার কথা জানায়, যা আজও বিদ্যমান। কমিশন যেসব সুপারিশ করেছিল, আমরা তা বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। মিয়ানমার তথা আর রাখাইনের মানুষের জন্য, যারা পালিয়ে গেছে- তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো কী হতে পারে, সে পথই দেখানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশেরও প্রশংসা করেন মর্গান।
ক্যাম্প এলাকার সহিংসতায় নাগরিকদের সতর্ক করল যুক্তরাজ্য
রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় চলমান সহিংসতা এবং সৃষ্ট নিরাপত্তাহীনতার প্রেক্ষিতে নিজ দেশের নাগরিকদের ভ্রমণ এবং চলাফেরায় সতর্ক থাকতে বলেছে যুক্তরাজ্য। গতকাল ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের জারি ওই ভ্রমণ সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, কক্সবাজারের দক্ষিণে উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় বিশেষত টেকনাফের ক্যাম্প (রোহিঙ্গা ক্যাম্প) এলাকায় ২৩ আগস্ট নিরাপত্তাহীনতা, প্রতিবাদ ও সহিংসতার নানা ঘটনা ঘটছে বলে রিপোর্ট পাওয়া গেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আপনাদের (ব্রিটিশ নাগরিকদের) উচিত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের উপদেশ মেনে চলা।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877